1. m.a.roufekhc1@gmail.com : alokitokha :
খাগড়াছড়িতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উদযাপন - আলোকিত খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়িতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি উদযাপন

  • প্রকাশিতঃ শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩

মো. আবদুর রউফ:
খাগড়াছড়িতে নানান আয়োজনে পালিত হয়েছে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে নানান আয়োজনের উদ্যোগ নেয় ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড খাগড়াছড়ি রিজিয়ন ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ। চুক্তির দীর্ঘ ২৬ বছর পূর্তিতে এ শান্তিচুক্তির সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করছে মানুষ। পাহাড়ে কতটা শান্তি ফিরেছে, কী কী সমস্যা রয়ে গেছে, চুক্তিতে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কি কি ধারা রয়েছে, আর কী করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। দিবসটিকে ঘিরে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি দিবস উপলক্ষে শনিবার (২ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় ঐতিহাসিক খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে বেলুন উড়িয়ে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালির উদ্বোধন করেন ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড খাগড়াছড়ি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোহতাশিম হায়দার চৌধুরী। এরপর খাগড়াছড়িতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব পোশাক ও বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হাজার হাজার পাহাড়ি-বাঙ্গালীর সমন্বয়ে বর্ণাঢ্য র‌্যালি প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইন্সটিটিউটে মিলিত হয়। পরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপুর সভাপতিত্বে সেখানে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬ তম বর্ষপূর্তির কেক কাটা হয়। কেক কাটা শেষে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে স্টেডিয়ামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর এর অস্থায়ী প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

এসময় ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড খাগড়াছড়ি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোহতাশিম হায়দার চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা, ডিজিএফআই শাখা ডেট কমান্ডার কর্ণেল এ এস এম বদিউল আলম, খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুমন, খাগড়াছড়ি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জোনায়েদ কবির, পুলিশ সুপার মুক্তা ধর, পৌর মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, “শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে। অনেক রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মিত হয়েছে এ অঞ্চলে। গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। প্রসার ঘটেছে পর্যটনশিল্পের। দুর্গম এলাকা সোলারের আলোয় আলোকিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির সিংহভাগ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।”

দিবসটি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে মাঠে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিষয়ে চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা, ভ্রাম্যমান সংগীত পরিবেশন ও বিভিন্ন অনাথালয়ে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।

এদিকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি দিবস উপলক্ষে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কমলছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসমাবেশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। শান্তিচুক্তি উদযাপন কমিটির সভাপতি অরোধ্যপাল খীসার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি বিমল কান্তি চাকমা, সাধারণ সম্পাদক অংশুমান চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক সুধাকর চাকমা, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এর সাংগঠনিক সম্পাদক অমর চাকমা সহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠের নেতাকর্মীরা।


আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, “দীর্ঘ ২৬ বছরেও পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান হয়নি। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে। বক্তারা আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হচ্ছে এবং উপজাতীয়রা দিন দিন সংখ্যালঘু থেকে লঘুতর হচ্ছে। পাহাড়ের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়নি। এখনো ভূমি বেদখল হওয়া অব্যাহত রয়েছে। এহেন এ পরিস্থিতিতে দ্রুত পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান বক্তারা। অন্যথায় কঠিনতর আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয় জনসাবেশ থেকে।”

অপরদিকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমান স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, “১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি নামে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা ছিল একটি বৈষম্যমুলক অসম চুক্তি। এ চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা আইন-কানুন তৈরি করেছে। পার্বত্য চুক্তির (ক) খন্ডের ১নং অনুচ্ছেদে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশ সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। চুক্তির পরে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে যা সংবিধানের ১নং এবং ৫৯ নং অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। পার্বত্য চুক্তির (খ) খন্ডের ২৬(ক) অনুচ্ছেদ মোতাবেক পার্বত্য জেলা পরিষদকে ভূমি সংক্রান্ত সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৩ নং এবং ১৪৪ নং অনুচ্ছেদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।” তিনি আরও বলেন, “পার্বত্য চুক্তির (খ) খন্ডের ২৯ এবং ৩২ নং অনুচ্ছেদ বাংলাদেশ সংবিধানের ৮০ নং অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। চুক্তির (খ) খন্ডের ৪(ঘ) এবং ৯ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ভোটার হওয়া সংক্রান্ত যে ধারা লিপিবদ্ধ হয়েছে তা বাংলাদেশ সংবিধানের ১২২ নং অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। চুক্তির (খ) খন্ডের ৮(ঘ) ধারার সাথে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(১) এর পরিপন্থী। এসময় অসম, অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সংশোধন ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাতিল করার দাবী জানানো হয়েছে।


১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত হয় পার্বত্য চুক্তি। এ ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ফিরে আসে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য বন্ধ হয়নি রক্তপাত-হানাহানি। ফলে অশান্তি রয়েই গেছে। মূলত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী বাহিনী। এছাড়া রয়েছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন, অপহরণ ইত্যাদিসহ বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে বিরাজমান বৈরীমূলক সম্পর্কের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছেই। এসবের ইতি টেনে পাহাড়ে কিভাবে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সুধীজনরা।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান সরকারের। সরকারের শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। বাকি ২৪টি ধারার ১৫টির আংশিক এবং ৯ ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। আর জনসংহতি সমিতির দুটি ধারার একটিও গত ২৫ বছরে পূরণ করেনি জেএসএস।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো সংবাদ